
যখন আমি খুব ছোট, সম্ভবত এরশাদ সরকার তখন ক্ষমতায়। সিলেটের যে থানা শহরে আমরা থাকতাম সেইখানে একটা আলু মেলা হয়েছিল। আলুর দোষ কী জিনিশ সেইটা সবাই জানেন। কিন্তু আলুর গুন সেইদিন আমি চর্মচক্ষে দেখেছিলাম। আলু নিয়ে রীতিমতো এক মেলা হয়েছিল। মেলার স্লোগান ছিল, বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান। মেলায় গিয়া আমার চোখ আলুপুরি হয়ে গেল। আলু ভর্তা, আলু ভাজি,আলুর কোপ্তা, আলুর কালিয়া এগুলো সবই আছে। সঙ্গে আছে আলুর ভাত, আলুর রুটি। আলুর মিষ্টি, আলুর দম। থানা শহরের সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা দোকান সাজিয়ে রীতিমতো আলুর মিনাবাজার তৈরি করেছিলেন। আলু দিয়ে কী না সম্ভব? সম্ভব অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। তখন খিয়াল করি নাই দেশে খাদ্য সংকট চলতেছিল কি না। স্কুলে পড়তাম তো। কিন্তু আলুর নানা পদ ও প্রকারভেদ সেইদিন আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। আলু নিয়ে কত ভেবেছি। কিন্তু মধ্যবিত্ত জীবনে আলু অভ্যাসে বৈচিত্র আসে নাই। ভর্তা, ভাজি বা তরকারির থোড়া ছাড়া আলুর আর কোন ভূমিকা পরবর্তী কালে লক্ষ্য করি নাই। জীবন চলে যাচ্ছিল। দুর্নীতি, সহিংসতা, বিএনপি আওয়ামী লীগ জীবন আকীর্ণ করে রেখেছিল।
আবার জীবনে আলু নিয়ে ভাবার সময় এলো। সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় আলুর দিকে তাকাবার অবসর মিললো। হে আলু দেখাও তবে তোমার রূপ। কী ভাবে কত ভাবে তোমাকে খাই বলো। আবার এসেছে আলু। কারণ, চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল। মরিচ, পেঁয়াজ, আলু নয় চালবাজ বাঙালির চালে এবার প্রকৃতই ঢিল পড়িয়াছে। চালের দাম বাইড়া গেছে গা। বাঙালি ভাত না খাইলে বাঁচিবে না। অতএব চাল না থাকিলে তাহার মৃত্যু অবধারিত।
চালের ঘটনায় আমার চোখ একেবারে খুলে গেছে। আগে ভাবতাম বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিশাল এক ষড়যন্ত্র পেঁচাইয়া সিভিল ও মিলিটারি সোসাইটি বইসা আছে। সুযোগ পাইলে নাইমা পড়বো। এখন বুঝতেছি। মনের ভিতরে ক্ষমতার যাতনা ছাড়া আর কিছুই তাহাদের মনে আছিল না। তা না হইলে যাদের শাসন করা হবে তারা কত টন চাল খায় তার হিসাব অন্তত তারা করতো। প্রথমে তো মনে হইতেছিল ক্ষমতা একপ্রকার হানিমুন। মধুচন্দ্রিমা যাপন করে চলে যাও। খোশ মে রহো। সংবিধানে তিন মাসের মধুচন্দ্রিমা বৈধ ছিল। কিন্তু আঠারো মাসে মধুচন্দ্রিমা মধুযাতনায় পরিণত হইলো। কী ছিল বিধাতার মনে। তিনি বাঙালিকে দিয়েছেন ভাতের ক্ষুধা, সঙ্গে বন্যা সিডর আর কর্মঅসংস্থান, মন্দা।
ফলে, আলুর কথা আইসা পড়লো। এসো হে আলু এসো এসো।
বৈশাখও আইসা পড়লো। চারদিকে ফ্যাশন শো। পান্তা-ইলিশ উৎসবও হইবে অনুমান করা যায়। দেশের মানুষ খেতে পাবে না আর আলু খোররা ফ্যাশন শোর টেবিল থেকে নেমে গিয়ে বটমূলে পান্তা চিবাবে। ভাবতে ভালোই লাগে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
হিডেন হাঙ্গার, নিরব দুর্ভিক্ষ আর সরব আলুর দেশে একটু সামনে তাকানো যাক। কাইলকা বিডিআর বলছে, বোরো উঠলেও চালের দাম কমবে না। পরশু সেনাপ্রধান বলছেন, সেনাবাহিনী এমন কিছু করবে না যাতে প্রশাসনের সামরিকায়ন হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, বিডিআর চাল বেচে ঠিক আছে। কিন্তু তারা কী কৃষি খাদ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও চালায়। তাদের সেই অবকাঠামো আছে? তারা কেমনে বলে চাউলের দাম কমবো না।
অবশ্য চাউলের দাম কমবো না সেইটা বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে না হইলেও সাধারণ জ্ঞানে বোঝা যাইতেছে। কারণ কী? কারণ বোরোতে আশানুরূপ ফল মিলিবে না। বাংলাদেশে হাইব্রিডের ক্যানভাসাররা এইবার এমন বীজ আনছে যে, ধানক্ষেতে এখন ত্রাহি ত্রাহি রব। পাতামরা রোগে ধান শীঘ্রই পাতানে পরিণত হইতেছে। কৃষকের হাতে এইসব পাতামরা জাতের ধান দিয়া ফলাইতে বইলা আরও বড় বিপদ ডাইকা আনা হইছে। এখন বোরো উঠলেও চালের দাম কমবো না। ফলে, আলু খাওয়ার অভ্যাসটা কয়মাসে একটু বাড়ানো ভাল। আর প্রার্থনা এই হে স্বর্গীয় আলু, আমাদের ছেড়ে যেও না।
আলুর দিকে সৃষ্টিশীলভাবে তাকান। হে আলু জীবন, এসো।
উপরিউক্ত লেখাটি নিচের link থেকে নেয়া হয়েছে
http://www.somewhereinblog.net/blog/mahbubmoreblog


No comments:
Post a Comment